যেসব উপায়ে স্মরণশক্তি বাড়াবেন

আপনি কি মনে করেন আপনার স্মরণশক্তি কমে যাচ্ছে? আপনি কি মনে করেন সূক্ষ্ম চিন্তা করার ক্ষমতা আপনার আগের মত নেই? যদি এমন হয়েও থাকে, কোনো অসুবিধা নেই। আপনি খুব সহজেই এ ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। কিন্তু কিভাবে?

তার আগে একটি মজার কথা জেনে রাখুন। মস্তিষ্ক গবেষকরা এখন বিশ্বাস করেন, স্মরণশক্তির স্বল্পতা, সূক্ষ্ম বা দ্রুত চিন্তা করার ক্ষমতা মানুষ ভাগ্যক্রমে বা জন্মগতভাবে অর্জন করে না। মস্তিষ্ক যত ব্যবহৃত হবে; তত এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এখানে বেশকিছু কৌশল দেয়া হলো, যা আপনার মস্তিষ্ককে পুরোপুরি কার্যক্ষম রাখতে সহায়তা করবে।

মস্তিষ্ক ব্যবহার করুন: ভিটামিন বি বেশি করে খাবেন। বিশেষজ্ঞের মতে, বৃদ্ধ বয়সে ভিটামিন বি’র অভাব হলে স্মরণশক্তি কমে যায়। বি ভিটামিন সবচেয়ে বেশি পেতে খেতে হবে সামুদ্রিক মাছ, গম, কলা, গাজর। নিয়মিত মস্তিষ্কচর্চা করতে হবে। কারণ মস্তিষ্কের ডেনড্রাইস নামক স্নায়ূকোষ সাধারণত শিক্ষিত মানুষের বেশি থাকে। বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের। এ কোষ বৃদ্ধি পায় মস্তিষ্কের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে। তাই বেশি বেশি বই পড়ুন আর ডেনড্রাইস দীর্ঘ করুন। বেশি তথ্য, চিন্তা, সূক্ষ্ম অনুভূতির শক্তি বাড়ান।

শরীরচর্চা করুন: আর হ্যাঁ। শরীরচর্চা তো করতেই হবে। কারণ শরীরচর্চা মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বৃদ্ধি করে। ফলে মস্তিষ্কে গ্লুকোজ বা শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এই গ্লুকোজ মস্তিষ্কের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। যা পরিচ্ছন্ন, সূক্ষ্ম ও দ্রুত চিন্তা করার জন্য অপরিহার্য। আপনি যদি মাঝবয়সী হয়ে থাকেন, তাহলে এখন থেকেই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করুন। মানসিক সুস্থতার জন্য রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের রক্তচাপ বেশি তাদের মস্তিষ্কের হোয়াইট ম্যাটার কোষগুলো তুলনামূলক কম। এই হোয়াইট ম্যাটার মস্তিষ্কে সংযোগকারী হিসেবে কাজ করে। ডিউক ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ সম্পন্ন ব্যক্তিদের তথ্য সরবরাহ করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের চেয়ে কম থাকে। প্রতিদিনের খাবারে অবশ্যই মাংস ও শাক-সবজি রাখা দরকার। মাংস ও শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমাণ খনিজ পদার্থ থাকে। বোরন এবং জিংক নামে দু’টো খনিজ পদার্থ মানুষের স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। প্রতিদিন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ৩.২৫ মিলিগ্রামের চেয়ে কম পরিমাণ এ খনিজ গ্রহণ করলে স্মরণশক্তি কমে যাবে। আপেল, আঙুর, ডাব, টমেটো, গম, দুধ এসবে প্রচুর বোরন এবং জিংক থাকে।

একঘেয়েমি থেকে দূরে: একঘেয়েমি থেকে দূরে থাকতে দৈনন্দিন অভ্যাসের পরিবর্তন করুন। যেমন ঘড়ির বেল্ট বদলান। নতুন ধরনের বই পড়ুন ইত্যাদি। এ ছাড়া দৈনিক সংবাদপত্রের পরিবর্তন করা যেতে পারে। ছোটখাটো ব্যতিক্রম বিষয় নিয়েও ভাবতে পারেন দু’তিন মিনিট। এতে অবসাদ থেকে মুক্ত হবেন। ঝরঝরে লাগবে। স্মরণশক্তি ঠিক রাখার ক্ষেত্রে ঘুম একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, যাদের রাতে ঘুমের ব্যাঘাত হয় অর্থাৎ ঘুমের মধ্যে বারবার জেগে ওঠেন; তাদের চেয়ে যারা একঘুমে রাত অতিবাহিত করেন, তাদের নতুন পড়া বিষয় পরদিন সকালে অনেক বেশি মনে থাকে।

কী করবেন না: সন্দেহ নেই, আমাদের শরীরের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ হচ্ছে আমাদের ব্রেইন। সবাই চাই আমাদের ব্রেইনের ক্ষমতা ক্ষুরধার থাকুক। তাই ব্রেইনের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর অভ্যাসগুলো কী কী, এবার তা জেনে নিন এবং সচেতন হোন। আমরা অনেকেই সকালের নাস্তা সময়মত খাই না অথবা একেবারেই খাই না। একসময় এটাই অভ্যাসে পরিণত হয়। যারা সকালের নাস্তা খায় না বা কম খায়, তাদের রক্তে চিনির পরিমাণ কমে যায়। এতে ব্রেইনে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পৌঁছাতে পারে না। ফলে ব্রেইনের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আবার দেখা যায়, অনেকেই নিজেদের খাওয়া কন্ট্রোল করতে পারি না। ফাস্টফুডসহ প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া আর ব্যায়াম না করা আজকের জীবনের সাধারণ চিত্র। বেশি খাওয়ার ফলে ব্রেইনের অ্যার্টারিগুলোয় চর্বি জমে শক্ত হয়ে যায়। ফলে মানসিক ক্ষমতা কমে যায়।

দূষিত এলাকা এড়িয়ে চলুন: ধূমপান করা একটা বাজে অভ্যাস। আমরা সবাই তা কম-বেশি জানি। আরও জানি যে, এটা ক্ষতিকর। তাও চালিয়ে যাই। ধূমপান করার ফলে মস্তিষ্কে বিভিন্ন রকম সঙ্কোচন ঘটে এবং সম্ভবত এর কারণে অ্যালজাইমারস (স্মৃতি হারানো) রোগ হতে পারে। মিষ্টি বেশি খাবার অভ্যাস রয়েছে অনেকেরই। রক্তে চিনির পরিমাণ বেশি হলে এটা প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রক্তে ঠিকমত আত্মীভুত হয় না। ফলে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হয়। এতে ব্রেইনের গঠন বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরিবেশ দূষণ এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে, এর থেকে রেহাই পাওয়া মুশকিল। তবুও অতিরিক্ত দূষিত এলাকা এড়িয়ে চলা দরকার। সকালে যখন যানবাহন কম থাকে; তখন বাইরে বের হয়ে ফ্রেস বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া যেতে পারে। ব্রেইন হলো আমাদের শরীরে অক্সিজেন গ্রহণকারী সবচেয়ে বড় অর্গান। তাই আমরা নিশ্বাসের সাথে যে বাতাস গ্রহণ করি তা যদি দূষিত হয়, তবে তা ব্রেইনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

বেশি রাত জাগবেন না: কম ঘুমানো ব্রেইনের জন্য ক্ষতিকর। রাত জেগে পড়াশোনা করা বা ফেসবুকে, ইউটিউবে, ইন্টারনেটে ডুব দেওয়া অনেকেরই অভ্যাস। ঘুমানোর সময় আমাদের ব্রেইন বিশ্রাম পায়। লম্বা সময় আমাদের ব্রেইনকে যদি ঘুম থেকে বঞ্চিত করা হয়। তবে ব্রেইনের কোষের ধ্বংস হবার হার বেড়ে যায়। আর হ্যাঁ, স্মরণশক্তি বাড়াতে ঘুমানোর সময় মাথা ঢেকে রাখবেন না। এটা বাজে অভ্যাস। ঘুমানোর সময় মাথা ঢেকে রাখলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কেন্দ্রীকরণের পরিমাণ বেড়ে যায়। অপর পক্ষে অক্সিজেনের কেন্দ্রীকরণের পরিমাণ কমে যায় এবং ব্রেইন ধ্বংসের কারণ ঘটায়। সে কারণে অসুস্থ অবস্থায় কাজ করা যাবে না। অসুস্থ অবস্থায় কঠিন কাজ করলে বা পড়াশোনা করলে ব্রেইনের কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়।

বিভিন্ন নতুন নতুন বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে আমাদের ব্রেইনকে উদ্দীপিত করার সবচেয়ে সেরা উপায়। চোখ-কান খোলা রাখলে চারপাশ থেকেই আমরা প্রচুর চিন্তার খোরাক পেতে পারি। ব্রেইনকে উদ্দীপিত বা জাগিয়ে তোলার মত ভাবনার অভাব ব্রেইনকে সঙ্কুচিত করে। মনে রাখবেন, কথা কম কাজ বেশি। এ মতে চললে তা ব্রেইনের জন্য খুব ভালো কিছু নয়। বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় অংশগ্রহণ, ব্রেইনের কাজ করার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। সাবধান! ঘুমের ওষুধ খাবেন না। কিছু কিছু ওষুধ সাময়িকভাবে হলেও মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এখন ইচ্ছা করলে আপনি সহজেই নিজের স্মরণশক্তি বাড়াতে পারেন। একবার চেষ্টা করেই দেখুন না, লাভ হয় কি-না!

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *